আলহাজ্ব হাফেজ মাওলানা বদরুদ্দীন রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
হাফেজ মাওলানা বদরুদ্দীন। পরিচিত সবাই তাঁকে “হাফেজ বদর সাহেব” নামেই চিনতেন। কর্মস্থলে সুদক্ষতার পরিচয় দেওয়া ও নিজ এলাকায় উল্লেখযোগ্য হাফেজদের অন্যতম হওয়ায় “হাফেজ সাহেব” নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। তাছাড়া যশোর বাঘারপাড়ায় তাঁর জন্মস্থান, সেই হিসেবে তিনি “বাঘারপাড়া হুজুর” নামেই লোকমুখে প্রশিদ্ধ।
তিনি ১৯৫০ ঈ সনে ২৫ই এপ্রিল মোতাবেক ৭ই রজব ১৩৬৯ হিজরীতে যশোর জেলার বাঘারপাড়া থানাধীন আগড়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
মরহুম মুন্সী আব্দুল আজীজ রহ. তিনি এলাকার আস্থাশীল মুরব্বী ও এলাকার গণ্যমান্য মৌলভীদের একজন ছিলেন। সে হিসেবে গ্রামে তিনি “আজীজ মুন্সী” নামেই প্রশিদ্ধ। তাঁর এই প্রশিদ্ধির কারণে এলাকার মানুষ আজও তাঁর সন্তানদের সমীহ করে চলে এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ ও সহযোগিতা কামনা করে।
মরহুমা জোহরা বেগম। শৈশবেই তাঁর আম্মার ইন্তেকাল হয়ে যায়। এরপর তিনি তাঁর সৎমায়ের কাছে মানুষ হন। পিতার ইন্তেকালের পর তিনি তাঁর ভাইবোনসহ ফুফুর কাছে বড় হন।
প্রাথমিক শিক্ষা:শৈশবে তিনি পিতার কাছে হাতেখড়ি নেন। এরপর নিয়মতান্ত্রিক স্কুলের পাঠ নিতে থাকেন। এলাকার মানুষের মাঝে তখন বিদয়াতের সয়লাব। মৌলভী সাহেবের সন্তান হওয়ার কারণে আগে থেকেই সঠিক দ্বীনের প্রভাব তাঁর ছিলো।
হিফজুল কুরআন:তাঁর পিতার অভিপ্রায়ও ছিলো ছেলেকে হাফেজে কুরআন বানানো। সেই সুবাদে বাড়ির কাছেই থাকা হেফজখানায় ভর্তি হন। সেখানে হাফেয আলতাফ সাহেব ও নাভারণের এক হাফেয সাহেবের কাছে হিফজ সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি যশোরের হাফেজ মুফতী আলী হোসেন সাহেবের কাছে হিফজুল কোরআন শোনানো শেষ করেন। সময়টা ছিলো পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে।
হেফজ শেষে যশোর রেল স্টেশনে মুফতী আব্দুল্লাহ সাহেব(মাগুরাবী) মুফতী আলী আকবর রহ. মুফতী আবুল হাসান রহ. এর কাছে ইবতেদায়ী সবক গ্রহণ করছিলেন। ইতিমধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যক্রমে এতে তিনি ফেঁসে যান এবং প্রায় ১৭ মাস কারাগারে আবদ্ধ থাকেন। আল্লাহ পাকের অশেষ মেহেরাবানীতে তাঁর কারামুক্তি হয়। হাজতে থাকা অবস্থায় প্রতিটা মুহূর্ত তিনি আল্লাহ তায়ালাকে বিশেষভাবে স্মরণ করেছেন। প্রতি ৩ দিনে এক খতম কোরআন খতম করেছেন। অনেক কয়েদীকে হেফজ পড়িয়েছেন। (আল্লাহ তাঁকে উত্তম জাযা দিন)
দাওরাতুল হাদীস:স্বাধীনের পর কারামুক্ত হয়ে ১৯৭৬ ই. পর্যন্ত পূর্ণ ৪ বৎসর মাগুরা শিমুলিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। এরপর পড়াশোনার প্রতি একটা আলাদা টান অনুভব করেন। ছাত্র যামানায় এভাবে শিক্ষকতা করাটা তিনি ভালো মনে করেন নি। তাই মুরব্বীদের পরামর্শ নিয়ে ১৯৭৭ ই. তে চলে যান মেখল মাদরাসায়। সেখানে ১৯৮২ই. পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে শরহে বেকায়া পর্যন্ত নেসাবভুক্ত জামাতগুলোর অধ্যায়ন সমাপ্ত করেন। এরপর ১৯৮৩ ই তে চলে যান ভাতুয়ায়। সেখানে দুই বৎসর পড়ার পর হাটহাজারীতে ১৯৮৫ ই. দাওরা হাদীস সমাপ্ত করেন।
এ সময়ে তাঁর সহপাঠী হিসেবে ছিলেন-
মরহুম আ.আজীজ সাহেব, কুষ্টিয়া।
মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস সাহেব, মাওলানা রুহুল আমীন, মাওলানা মাজহারুল ইসলাম, মাওলানা আহমদ আলী, দড়াটানা মাদরাসা যশোর,
মাওলানা শামসুল হক।
মাওলানা রফিকুল ইসলাম যশোরী প্রমুখ
১৯৮৩ ঈ. তে ভাতুয়ায় পড়াকালে মুফতী আব্দুল্লাহ মাগুরাবী (নোয়াপাড়া) ও মুফতী নূরুল আমীন এবং মুফতী মুমতাজুল করীমসহ কয়েকজনের প্রচেষ্টায় মরহুম আবু বকর সিদ্দীক (বড় উস্তাদজী) এর সেজো কন্যা হাফেজা সালেহা বেগমের সাথে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়।
ফারেগের পর আপন শ্বশুর আলহাজ্ব আবু বকর সিদ্দীক রহ. এর পরামর্শক্রমে শ্বশুরালয় মাগুরার শাহজিরকান্দী গ্রামে হেফজখানার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দু’বৎসর সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তাঁর মুশফিক উস্তাদ মরহুম আলী আকবর রহ. এর পরামর্শে যশোর দড়াটানা মাদরাসার প্রাথমিক উস্তাদ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তিনি জীবিত থাকাবস্থায় তাঁর শুভদৃষ্টি নিয়ে এবং তাঁর ইন্তেকালের পরও দীর্ঘদিন এ খেদমত আঞ্জাম দেন এবং ইন্তেকাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৩৪ বৎসর সেখানেই ছাত্রদের কোরআনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন।
এছাড়াও তিনি যশোরের কয়েকটি মসজিদের ইমামতি ও খতীবের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর সব যায়গাতেই তিনি যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর দায়িত্বপ্রাপ্ত মসজিদগুলোর তালিকা-
যশোর কোতয়ালী মসজিদ,
দাদাভাই মিল মসজিদ,
আরবপুর কেন্দ্রীয় মসজিদ,
বায়তুল মামুন জামে মসজিদ যশোর,
বাইতুল ফালাহ জামে মসজিদ।
সর্বশেষ মসজিদটিতে দায়িত্বরত থাকতেই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায়।
একজন জান্নাতী মানুষের যেমন আখলাক হওয়া জরুরী তিনি ঠিক তেমনটি ছিলেন। রসিক মানুষ ছিলেন। সবার সাথে সহজে মিশে যেতেন। কারো দোষ অন্বেষণে তিনি খুবই বিরক্তবোধ করতেন। তাঁর দায়িত্বের বেশী অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় নষ্ট করা পছন্দ করতেন না। ওয়াদা ঠিক রাখতেন। যা করতেন, নিয়মিত করতেন। হক্ব কথা বলতে জায়গা নির্ধারণ করতেন না, নববী আদর্শ ধারণ করে তৎক্ষণাৎ ধরে বসতেন। ধৈর্যে ছিলেন পাহাড় সমান। তাওয়াক্কুলে তিনি প্রথম কাতারের বুজুর্গ ছিলেন। ছোটদের স্নেহ ও বড়দের (ইলমে হোক বা আমলে কিংবা বয়সে) সমীহ করে চলতেন। কথায় রাখঢাক রাখতেন না। সরলতার কারণে অনেক সময় ছোটদের মজলিসে বড়দের নসীহত করে দিতেন। সহকর্মীরা কেউ মজাক করলে হেসে উড়িয়ে দিতেন। কেউ কথায় বা কাজে কষ্ট পেলে তার কাছে নির্দ্বিধায় ক্ষমা চেয়ে নিতেন। ছাত্রদেরকে নিজের সন্তানের মত করে দেখতেন। এমনকি তাঁরই ছত্রছায়ায় অনেক ছাত্র ইলম অর্জন করে ফারেগ হয়ে গিয়েছে। উস্তাদের ব্যাপারে ভালোমন্দ কিছু বলতেন না। কেউ কিছু বললে তাকে আরো শাস্তি দিতেন। তড়িঘড়ি করে কোনো কাজ করাকে পছন্দ করতেন না। কোনো কাজ করলে তা পূর্ণ করেই ফিরে আসতেন। শরীয়তবিরুদ্ধ কারণ ছাড়া কারো সাথে কথা বন্ধ রাখতেন না। অন্যকেউ কথা না বললেও তিনি গিয়ে আগে আগে সালাম দিতেন। এছাড়া আগে সালাম দেওয়া তাঁর চিরাচরিত অভ্যাস ছিলো। তাঁকে সালাম দিয়েছে, এমন লোকের সংখ্যা হাতেগোনা। এমনকি কারো কারো সাথে এ নিয়ে তাঁর প্রতিযোগিতা চলতো। দ্বীনের কারণে অন্যের কাছে নত হওয়াকে তিনি অপমান মনে করতেন না। তবে অন্যায়কাজে তিনি নত হতেন না। তিনি ছিলেন দৃঢ়চিত্তের মানুষ। জীবনে এত চড়াই-উৎরাই; গঠনে কিংবা মননে বোঝা যেতো না। তিনিও কাউকে তা বুঝতে দিতেন না। একটা কথাই তিনি সবাইকে বলতেন- “আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, তিনিই সবকিছুতে ভাল ব্যবস্থা করে দিবেন। যে অবস্থায় আছো, সে অবস্থাতেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো, রিযিক, সম্মান বেড়ে যাবে।”
আহামরি কোনো ইবাদত তিনি করতেন না। তবে যা করতেন নিয়মিত করতেন। ইবাদতগুলো কাউকে দেখানোর জন্যও করতেন না। আবার কাউকে দেখে কোনো ইবাদত ছেড়েও দিতেন না। তাঁর আমলগুলো ছিলো সাজানোগুছানো। সেই ফজর উঠেই আগে আগে সবাইকে ডেকে দেওয়া ছিলো তাঁর প্রথম আমল। উজু করে এসে তাহাজ্জুদের সময় থাকলে তাহাজ্জুদ পড়তেন। না হয় ফজরের সুন্নাত পড়ে জায়নামাজে বসে আমল করতেন। নামাজের সময় হলে মসজিদে যেতে যতগুলি বাড়ি পেতেন, দরজায় টোকা দিয়ে নামাজে যাবার জন্য ডেকে যেতেন। আজও সবাই তাঁর সেই ডাক অনুভব করে। নামাজ পড়ে এসে মামুলাত আদায় করতেন। এসময় ঘুমের ঘোরে বসতে না পারলেও কষ্ট করে আমলগুলো শেষ করতেন। প্রতিনিয়ত আমল বাড়াতেন। আমল শেষে বাসার কাজ থাকলে তা করে মাদরাসায় রওয়ানা হতেন। দরস-তাদরিস শেষে নামাজের আগে মসজিদে পৌঁছে যেতেন। প্রতিদিন নামাজে একপারা করে পড়তে চেষ্টা করতেন। প্রত্যেক নামাজ শেষে সময় পেলে একপারা তেলাওয়াত করতেন। এমনকি রমজানের পূর্বে লকডাউনে পারিবারিকভাবে ৪১ খতম পড়েন। তাঁর মধ্যে বেশীরভাগ তিনিই পড়েন। রমজানেও তিনি অগণিত খতম করতেন। জীবনে কোন এক ছেলের পিছনে তারাবীহতে এক খতম পড়ার খুব খায়েশ ছিলো তাঁর, আল্লাহ তায়ালা তাঁর মেজো সন্তানের মাধ্যমে সে আশা পূর্ণ করে দিয়েছেন। একসাথে খানা খাওয়ার জন্য সবাইকে তাগিদ দিতেন। নামাজ-কালামে কেউ গাফেল কিনা সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। এমনকি মাঝে এ নিয়ে বকাঝকাও করতেন। শেষ বয়সে তাঁকে দু’বেলা মাদরাসায় যেতে হতো, তিনি কোনো রা’ না করেই বেতাকাল্লুফ সাইকেল চালিয়ে মাদরাসায় চলে যেতেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, এটা আল্লাহর জন্য করি। মাদরাসা, মসজিদ ও বাড়ি, সব যায়গায়ই সবার সাথে মিলেমিশে চলতেন। বর্তমান সময়ে তাবলীগের সমস্যায় কেউ যেনো ভুল পথে না চলে যায়, সেই চেষ্টা করতেন। চিন্তা করতেন। সাথীদের অনেক সময় দিতেন। রাতে নামাজ পড়েই শোবার প্রস্তুতি নিতেন। বয়সের কারণে অনেক সময় ঘুম না এলে নামাজ, কুরআন তেলাওয়াতে মশগুল থাকতেন। অনেকদিন এমন হতো, তিনি ঘুমাননি, ইবাদতে কাটিয়ে দিয়েছেন। ইবাদতের ক্ষেত্রে এর চেয়ে আর বেশী কী দরকার, যা করবে নিয়মিত করবে। তাঁর আমলগুলো দেখে হয়তো তাঁকে অতবেশী আমলদ্বার মনে না করলেও তাঁর আমলগুলো ছিলো সুন্নাহ মোতাবেক, নিয়মিত।
তাকওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন প্রকৃত খোদাভীতু মানুষ। মানুষ কী বলবে, সেই পরোয়া নিজেও করতেন না, অন্যকেও করতে দিতেন না। হক্বভাবে চলতে চেষ্টা করতেন। বলতেন, যা করি আল্লাহর জন্য করি, ফলাফল আল্লাহ দিবেন। যারা তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলো, তারা তাঁকে খুবই সমীহ করতো; শত্রুরা দূর থেকে যাই করতে চেষ্টা করতো, তাঁর সামনে আসতে সাহস করেনি কখনো।
তাওয়াক্কুলের ক্ষেত্রে তিনি একজন দৃঢ়চিত্তের মানুষ। আল্লাহর উপর ভরসা করলে এটাই বলতেন যে, ইনশাআল্লাহ আল্লাহ ভালো ফয়সালা করবেন। খুব বেশী বিচলিত হতেন না কোনো কাজে। এমনকি করোনার এই দুর্যোগে তাঁর একটিই কথা ছিলো- আল্লাহ খাওয়ানোর মালিক, তিনি এতদিন খাইয়েছেন, আরো খাওয়াবেন। বাস্তবেও লকডাউনের মধ্যেও প্রায়দিন বাজার করতেন। পরিবারকে খুবই ভালো ভালো খাইয়েছেন। এমনকি ইন্তেকালপূর্ব অসুস্থতার আগে পরিবারের আগামী একমাস যা যা লাগবে, আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে কিনিয়ে দিয়েছেন। তাঁর তাওয়াক্কুলের ফলাফল আল্লাহ তাঁকে দুনিয়াতেই দিয়েছেন। আখেরাতেও আল্লাহ তাঁর জন্য উত্তম ফয়সালা করেন।
হাফেজ মাওলানা বদরুদ্দীন সাহেবের আমল-আখলাক মুয়ামালাত এবং মুয়াশারাতের কথা বলে শেষ করা যাবে না। হাদীস শরীফে এসেছে, “জান্নাতী লোকদের জীবন যাপন সাদাসিদা হয়, সাদামাটা হয়”। এ হাদীসের বাস্তব নমুনা ছিলেন তিনি। জীবনে কোনদিন সম্পদ ও অট্টলিকার আগ্রহী ছিলেন না। তিনি সব সময় মসজিদ মাদ্রাসার খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। মসজিদ মাদ্রাসার উন্নতির ফিকিরেই ব্যস্ত ছিলেন। তিনি বিনয় এবং নম্র স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। তিনি সীমাহীন সহনশীল এবং ধৈর্যশীল ছিলেন। কোনদিন নিজের অসুবিধার কথা কারোর কাছে মুখ খুলে বলতেন না। পরোপকারী ছিলেন।
কারো সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে তাকে দেওয়া সময়ের খুব খেয়াল রাখতেন। সঠিক সময়ে তাঁর পাওনা বুঝিয়ে দিতেন। না দিতে পারলে অবশ্যই তার থেকে সময় চেয়ে নিতেন। এক্ষেত্রে আত্মীয়-অনাত্মীয় ভেদাভেদ করতেন না। তাঁর প্রতিবেশীসহ পরিচিতজনের সাথে লেনদেনগুলো ছিলো একেবারে পারিবারিকের মতো। কোনো প্রতিবেশীর সাথে উচ্চবাচ্য না করে সমাধানের পথেই হাঁটতেন। এমনকি তাঁর সাথে প্রতিবেশীর রূঢ় আচরণের কারণে অনেকেই তাদেরকে গালমন্দ করতো, তিনি বারণ করতেন। বরং সহজে সমাধান হয় সে পথই বেছে নিতেন। যে কারো সাথে সহাস্যমুখে কথা বলাটাই ছিলো তাঁর হুসনে খুলুকের নিদর্শন। সবার সাথে তাঁর অভিভাবকসুলভ আচরণের কারণে সবাই তাঁর প্রকাশ্য আর্থিক, সামাজিক সরাসরি সহযোগিতা না নিতে পারলেও তাঁকে উত্তম পরামর্শদাতা মনে করতো। এমনকি তাঁর পরামর্শে চলার কারণে এখনও অনেকেই ভালো অবস্থানে আছে। (যদিও বিষয়টি অনেকের অজানা) দ্বীনকেন্দ্রিক যেকোনো কাজে নিজেও আগে থাকতেন অন্যদেরকেও এগিয়ে দিতেন। কারো কোনো কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াতেন না। কাউকে ঠকানো বা কথার হেরফেরের চেষ্টা থেকে তিনি সবসময় বিরত থাকতেন।
আমানতের ক্ষেত্রে সবসময় তিনি খেয়াল রাখতেন, যেনো খেয়ানত না হয়ে যায়। তাঁকে যে দায়িত্ব দেওয়া হতো, তিনি সে দায়িত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করতেন। শেষ বয়সে এসে বয়সের ভারে কিছুটা এদিকওদিক হয়ে গেলেও যথাসম্ভব চেষ্টা করতেন আমানতকে রক্ষা করতে। মাদরাসার দায়িত্বকে গুরুদায়িত্ব জ্ঞান করতেন। মসজিদকে সাধারণের জন্য আস্থার যায়গা হিসেবেই জানাতেন। ঘরের আমানত, নিজের বিষয়ে ও অন্যের বিষয়ে যে আমানত তাঁর কাছে গচ্ছিত ছিলো, তিনি তাঁর খেয়ানত করেন নি। এমনকি এমন অনেক বিষয় আছে, যে গুলোতে সাধারণত মানুষ আমানতের বিষয় মনে না করে ঘরের লোকদের বলে, তিনি তা করতেন না। তাই ঘরের লোকদের অনেক বিষয়েই অজানা রয়ে গেছে। তবে যেগুলো অন্যকে বুঝিয়ে দিতে হবে, সেগুলো আগে এসে বাসায় বলতেন যে, “অমুকের সাথে আমার এমন লেনদেন হয়ে বা এই কথাবার্তা হয়েছে। মনে রেখো এটা/এগুলো তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। দিন-তারিখসহ লিখে রাখতেন। ইন্তেকালের পর তাঁর ড্রয়ার খুলে কাগজপত্র নাড়াচাড়া করার সময় ছোট ছোট কাগজে এমন অনেক তথ্যই দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তাছাড়া মাদরাসা-মসজিদের সমস্ত হিসাবকিতাব এক জায়গায় করেছিলেন, যেনো বুঝিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু আল্লাহর ফয়সালা মেনে নিয়ে তাঁরই সাক্ষাতে রওয়ানা হয়ে গেলেন। (রহিমাহুল্লাহু তায়ালা বিফাদলিহিল কারীম)
তিনি অগণিত হাফেজ আলেমের উস্তাদ ছিলেন। সালেহীন বুযুর্গানে দ্বীনের মত তাঁর আমল-আখলাক ছিলো। নবীর জীবনের উত্তম আদর্শ অনুসরণ করে চলতেন। ছেলে-মেয়েদেরকে তিনি হাফেজ-আলেম বানিয়েছেন। নিজের সব ছেলে-মেয়েদেরকে কওমি মাদ্রাসায় পড়ানোর এটাই লক্ষণ যে, তিনি একজন আখেরাতমুখী আল্লাহ ওয়ালা মানুষ ছিলেন। ছাত্রদেরকে কীভাবে গড়লে আদর্শ ছাত্র হবে, তা তাঁর অতীত জীবন ঘাটলে পাওয়া যাবে। মাগুরা শিমুলিয়াতে যখন উস্তাদ হিসেবে ছিলেন, কয়েক পরিবারের সব ছোট সদস্যই তাঁর কাছে পাঠ নিয়েছে। এমনকি সবাই এখন বড় বড় আলেম হয়েছে। এরপর যখন তিনি তাঁর শ্বশুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শাহজিরকান্দি মাদরাসায় ছিলেন, তখনও এমন অবস্থা ছিলো। এমনকি অনেকের মুখে শোনা যায়, হুজুর তখন যা শিখিয়েছিলেন, আজ তা দিয়েই দ্বীন মেনে চলছি। যখন তিনি হিফজ বিভাগে পড়াতেন, তখনকার সময়ে পুরো জেলাতেই সাড়া জাগিয়েছিলেন। একজন যোগ্য উস্তাদের যতগুলো গুণ থাকা দরকার, তাঁর মধ্যে পরিপূর্ণরূপে ছিলো। “অন্যের ভালো কামনা করলে নিজের ভালো হয়” এর উপমা ছিলেন তিনি। তাঁর সন্তানদের অধিকাংশই তাঁর জীবদ্দশাতে ভালোমানের হাফেজ-আলেম হয়েছে। সন্তানদের ক্ষেত্রেও তিনি শুধুমাত্র আদুরে হাত বুলিয়ে দেওয়ার মানুষ ছিলেন না। সবসময়ে আলাদা দেখাশোনা করতেন। আল্লাহ তাঁর কবরকে জান্নাতের বাগানে রূপান্তর করুন। আমীন
উলামায়ে কেরামের দৃষ্টিতে: যশোরসহ আশপাশের জেলাগুলোতেই তাঁর বিচরণ ছিলো। যেহেতু শহরের অনেক বড় বড় মসজিদে তিনি দায়িত্বশীল ছিলেন। এছাড়াও ইন্তেকাল পর্যন্ত দড়াটানা মাদরাসাতেই খেদমতরত ছিলেন, সেই হিসেবে উলামায়ে কাছে তিনি মুখচেনা একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের সংবাদে অনেক আলেমের মুখেই “আহ! এমন একজন মানুষ আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিলেন! আমরা একজন সত্যিকার ভালো মানুষকে হারালাম। ” আহাজারী শোনা গেছে। তাঁর দূরের উস্তাদগণের সাথে তিনি দেখা করার জন্য সফর করতে না পারলেও কোনো উস্তাদ যশোর ও আশেপাশের জেলায় আসছেন শুনলে ছুটে যেতেন যেকোনো মূল্যে। ছাত্র হয়েও অনেক উস্তাদের চোখেও তিনি সম্মানিত ছিলেন। উস্তাদগণ তাঁকে মনে রেখেছিলেন। এমনকি যশোর থেকে কেউ তাঁদের সাথে দেখা করতে গেলে তাঁর কথা জিজ্ঞেস করতেন। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনে অনেক উস্তাদই ফোন করে তাঁর পরিবারের খোঁজ নিয়েছেন। এছাড়া তাঁর দিকে লক্ষ্য রেখেই উলামায়ে কেরাম তাঁর পরিবারবর্গের দিকে নজর রেখেছেন।
ছাত্র-তুলাবার দৃষ্টিতে তিনি:
ছাত্রদের দৃষ্টিতে তিনি একজন মজার মানুষ ছিলেন। তিনি ছাত্রদের সাথে মজা করতেন এবং ছাত্ররাও তাঁর সাথে হাসি-মজাক করতো। তিনি ছাত্রদের সুযোগ-সুবিদার পক্ষে ছিলেন সবসময়। কিন্তু অনিয়মের সাথে আপোষ করতেন না। কোনো অনিয়ম হলে নিজেও ছাড় দিতেন না। দায়িত্ব অন্যের হাতে ন্যস্ত হলে ন্যায়বিচারের কথা বলতেন। সবমিলিয়ে ছাত্রদের জন্য তিনি ছিলেন একজন উদার মানসিকতার উস্তাদ। এজন্য ছাত্ররাও তাঁকে সেভাবে সম্মান করতো। প্রয়োজনে তাদের সমস্যার কথা জানাতো। তিনি নিজেও অনেক ছাত্রের খোঁজ রাখতেন। তাদের খরচ বহন করতেন। সমস্যা সমাধানের জন্য পরামর্শ ও সহযোগিতা করতেন। হযরতের ইন্তেকালে তাঁর ছাত্রগণ দিলে প্রচণ্ড এক ধাক্কা অনুভব করেছে। আল্লাহ ছাত্রদের দিলের এ ব্যথা উপশম করুন। তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন।
জনসাধারণের দৃষ্টিতে তিনি:
৪ ছেলে ও ৪ মেয়ে।
কন্যাদের সকলের বিবাহ হয়ে গেছে এবং চার ছেলের মাঝে বড় ও মেজো ছেলের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। বাকী দুইজনের একজন ইফতা শেষ করে খেদমতে আছে এবং অপরজন অধ্যায়রত আছে।
ছেলেদের নামের তালিকা
বড় ছেলে: মুফতি আফফান কাসেম
ইমাম-খতীব: মসজিদে রব্বানী, নীলগঞ্জ শাহপাড়া, যশোর।
মেজো ছেলে: হাফেজ মাওলানা মুফতি আসেম বিল্লাহ
মুহতামিম: নূর মুহাম্মদ কমপ্লেক্স কওমী মাদরাসা (বালক-বালিকা) সাভার, ঢাকা
সেজো ছেলে: হাফেজ মাওলানা মুফতি মাসুম বিল্লাহ সালিম
উস্তাদ: বাহাদুরপুর দারুস সুন্নাহ মাদরাসা, নতুন উপশহর, যশোর।
ছোট ছেলে: হাফেজ খালিদ মাহমুদ
শিক্ষার্থী: এদারাতুত তাওহীদ কওমী মাদরাসা, ঝাউদিয়া, কুষ্টিয়া
মেয়ের জামাতাগণের নামের তালিকা:
বড় জামাতা: মুফতি মুখলিসুর রহমান, (প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম: আল মাদরাসাতুন নূরিয়া কওমী মাদরাসা,নূরবাগ,ষোলশত,নাজিরপুর,পিরোজপুর)
মেজো জামাতা:
সেজো জামাতাঃ হাফেজ মাওলানা মুফতি নোমান কারীম (
৪র্থ জামাতা: হাফেজ মুুুুুহাম্মদ ইসমাইল (তারাগঞ্জ, যশোর)
তাঁরা ৭ ভাই ৪ বোন
নিম্নে ভাইদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো-
বড় ভাই: প্রফেসর শামছুর রহমান, তিনি নড়াইল একটি কলেজের অধ্যক্ষ।
মেজোভাই: গোলাম রসূল, তিনি গ্রামের বাড়িতে থাকেন। চাষাবাদ করেন।
হাফেজ মাওলানা বদরুদ্দীন সাহেব রহ. ছিলেন সেজো ভাই।
৪র্থ ভাই: সদরুদ্দীন, তিনি গ্রামেই চাষাবাদ ও নিজের দোকান চালান।
৫ম ভাই: মরহুম প্রফেসর আবু বকর সিদ্দীক, তিনি নড়াইল সদর কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন।
৬ষ্ট ভাই: হাফেজ রবিউল ইসলাম, তিনিও চাষাবাদ করেন। ছেলেরা আলেম, প্রবাসী।
৭ম ভাই: হাফেজ মাওলানা মফিজুর রহমান, তাঁরা এই দুইভাই হাফেজ-আলেম। তিনি শান্তিবাগ টাইলস মসজিদের ইমাম ও খতীব পাশাপাশি মাদরাসা সংলগ্ন হিফজখানার খেদমতরত আছেন।
তাঁর বরকতে তাঁর পরের ভাইগুলো মাদরাসায় পড়ার সুযোগ পেয়েছে।
বড় বোন: সবুরা বেগম
মেজো বোন: ফাতেমাতুজ জোহরা, আন্দুলবাড়িয়া, বাঘারপাড়া, যশোর।
সেজোবোন: মরহুমা রহিমা বানু (শৈশবেই তার ইন্তেকাল হয়)
ছোটবোন: হালিমাতুস সাদিয়া, রায়জাদাপুর, আড়পাড়া, মাগুরা।
এক:
মরহুম মাষ্টার গাউসুর রহমান
দুই:
মরহুম মো. রিজাউল কবীর
তিন:
আলহাজ্ব মাওলানা আব্দুল আজীজ (রহ.) [যিন হজ্রব্রত পালন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর কবর মক্কার হাজী সাহেবগণের কবরস্থানে দাফন করা হয়]
মাওলানা শাহ আহমাদ শফী রহ., মুফতি আব্দুল্লাহ মাগুরার হুজুর দা. বা, মুফতি আলী আকবর রহ., মাওলানা রজব আলী রহ., মাওলানা আবুল হাসান রহ., মুফতি ফয়জুল্লাহ রহ, মুফতি আহমাদুল হক রহ., মাওলানা নোমান কাসেমী প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ বুজুর্গ আলেমগণ।
তিনি সর্বপ্রথম আবরারুল হক সাহেব রহ. হাতে বাইয়াত হন। এরপর শাহ হাকীম মুহাম্মদ আখতার সাহেব রহিমাহুল্লাহুল বারীর হাতে বাইয়াত হন। এছাড়া হাটহাজারীর নূর আহমাদ সাহেবের সাথে তাঁর হৃদয়ের সম্পর্ক ছিলো। হযরত তাঁকে এক নামেই চিনতেন। পরে মুফতী নূরুল আমীন দা.বা. এর পরামর্শে তার হাতে বাইয়াত হন।
তাঁর সন্তানগণ সবাই তাঁর ছাত্র, ভাগ্নেরা অনেকে এবং ভাইপোরাও অনেকেই ছাত্র। মুফতী খবিরুল্লাহ রহ., মাওলানা নাসিরুল্লাহ, মুফতী আব্দুর রহীম, শায়খ আহমাদুল্লাহ,
তিনি আলেম হওয়ার সুবাদে তাঁর বংশে তাঁর পরবর্তী ভাই-বোনদের ছেলে-মেয়েদেরকে দ্বীনী শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেন। পরে যশোর শহরে চলে আসার পর মাঝে মাঝে গ্রামে যেতেন, সেই সুবাদে দ্বীনী শিক্ষার ধারাটা অব্যাহত থাকেনি। তবে তাঁর সংস্পর্শে যারা ছিলো, তারা আলেম হয়েছে। তাঁর বংশে আলেম-ওলামা প্রায় ২০ এর কাছাকাছি।
এছাড়া বিবাহ সূত্রে তিনি মরহুম আবু বকর সিদ্দীক ও মুফতী আব্দুল্লাহ মাগুরাবী দা.বা. এর সাথে সম্পৃক্ত। এই বংশে আলেম-উলামার সংখ্যা অগণিত।
০৯৫১-০১ পূর্ব বারান্দী, মোল্লাপাড়া রোড, কবরস্থানপাড়া, যশোর।
আস-সিদ্দীক ফাউন্ডেশন
শাহজিরকান্দি, মুসাপুর বাজার, মাগুরা।
মোবাইল : 01712-544865, 01712-572359, 01967-119283
ওয়েসবাইট: www.assiddik.com
ইমেইল : info@assiddik.com, assiddik.com@gmail.com
সাংগঠিনিক পদ: তিনি আস-সিদ্দিক ফাউন্ডেশন এর উপদেষ্টা ছিলেন
১৩ জিলকদ ১৪৪১ হিজরী মোতাবেক ৫ ই জুলাই ২০২০ রোজ রবিবার বিকাল ৪টা ৪৫ মি: সালাতুল হাজাত আদায় করে বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ এই দুআ পাঠ করতঃ হাসপাতলে যাওয়ার পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিঊন। যশোর বারান্দীপাড়া মোল্লাপাড়া গোরস্থানে ঢোকার পথে ডান হাতের দ্বিতীয় কবরটিতে তাঁকে দাফন করা হয়। আল্লাহ তা’আলা তাকে নিজ রহমতে মাফ করুন এবং রহমত বর্ষণ করুন।
হাফেজ মাওলানা বদরুদ্দীন সাহেবের আমল-আখলাক মুয়ামালাত এবং মুয়াশারাতের কথা বলে শেষ করা যাবে না। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘জান্নাতী লোকদের জীবন যাপন সাদাসিদা হয়, সাদামাটা হয়’। এ হাদীসের বাস্তব নমুনা ছিলেন তিনি।
এমন একজন ব্যক্তিকে, যে স্ত্রী হারিয়েছেন, সেই কেবল বুঝতে পারবে, কেমন স্বামী হারিয়েছি?
তার সন্তানই কেবল বুঝতে পারবে, কেমন পিতা হারিয়েছি?
তার ছাত্ররাই বুঝতে পারবে, কেমন আদর্শ ও দয়াবান শিক্ষককে তারা হারিয়েছে?
নাতি-নাতনি গণই বুঝতে পারবে, কেমন নানাকে তারা হারিয়েছে?
তার জামাইরা বুঝতে পারবে, কেমন একজন শশুরকে তারা হারিয়েছে?
আল্লাহ তা’আলা তাকে নিজ রহমতে মাফ করুন এবং রহমত বর্ষণ করুন।