মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিলাদত উপলক্ষে ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে বিশেষ আয়োজন ও সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ ও তাঁর জন্মদিবস উদযাপনই এই সকল আয়োজনের লক্ষ্য। নানা ধরনের বিশেষ বিশেষ কার্যক্রমে আকৃষ্ট হয়ে বিপুল সংখ্যক মুসলমান মেতে ওঠে এবং নানাভাবে অংশগ্রহণ করে। এ বিষয়ে কোনো ঈমানদার মুসলমানের মধ্যেই কোনোরূপ দ্বিমত নেই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্মরণ ও তাঁর জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষাগ্রহণ খুবই বড় রকমের একটা পূণ্যকর্ম। উল্লেখ করা বাহুল্য যে, আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা বিশ্বব্যাপী মুসলমানের একটি স্পষ্ট চরিত্রবৈশিষ্ট্য, যা বহু শতাব্দী ধরে এই উম্মাহর মধ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে সক্রিয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি উম্মাহর পক্ষ থেকে মুহাববতে এখনও কোনো পরিবর্তন আসেনি সত্য, কিন্তু ভালোবাসার প্রকৃতি বদলে গেছে। প্রথম সময়ের ভালোবাসা ও ভক্তির মধ্যে আমরা যা অবলোকন করি, সেই ভালোবাসা এখন ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করেছে। সাহাবীরা রা. ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, স্বতন্ত্র ধরনের মানুষ। তাঁরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রত্যক্ষ সাহচর্য লাভ করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট থেকে সরাসরি শিক্ষাপ্রাপ্ত। তাঁর সঙ্গে বহু জিহাদে অংশগ্রহণকারী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সংগ্রামী মিশনে তাঁরাই ছিলেন সমর্পিত অগ্রসৈনিক, যারা হাসিমুখে জীবন কুরবানী করে দিয়েছেন এবং এমন কৃতিত্বের তাঁরা অধিকারী, যা তাঁদেরকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্ত ও অনুগামী ও অনুসারী হিসাবে অক্ষয় পরিচিতি দান করেছে।
সাইয়্যিদুনা মুসআব ইবনে উমাইর রা. ছিলেন এই সাহাবীদেরই অন্যতম। তিনি যখন মক্কার একজন যুবক-মুশরিক, তখন তিনি ছিলেন পোশাক-পরিচ্ছদে সর্বাপেক্ষা সুসজ্জিত এবং সর্বাধিক সৌন্দর্যসচেতন। তিনি যখন বহু মূল্যবান রেশমিবস্ত্র পরিহিত অবস্থায় উৎকৃষ্ট সুগন্ধি মেখে রাস্তা দিয়ে চলতেন পেছতে ছড়িয়ে পড়ত এক মুগ্ধকর সুবাস ও সৌরভ। তারপর এক নতুন ঘটনা। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে সাক্ষাত করলেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পয়গাম তাঁর হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করল। তাঁর জীবন আমূল বদলে গেল। তাঁর স্নেহময়ী মুশরিক জননী তাঁকে ঘৃণা করতে শুরু করল। আর শুধু ঘৃণাই নয়, তাঁর উপর শুরু হয়ে গেল চরম শাস্তি ও নির্যাতন। তিনি হয়ে গেলেন ধনাঢ্য থেকে ছিন্ন-মলিন বস্ত্র পরিহিত এক হতদরিদ্র ব্যক্তি। একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখলেন। দেখলেন, পুরাতন চামড়ার তালি দেওয়া শত চ্ছিন্ন-বস্ত্র তাঁর পরিধানে এবং দেখলেন, কী কঠিন দুঃসহ জীবনই তাঁকে বরণ করে নিতে হয়েছে। তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘কয়েক বছর আগে আমি মক্কাতে এই যুবককে দেখেছি, তখন তার চাইতে সুদর্শন ও সৌন্দর্যবিলাসী ও উত্তম পরিচ্ছদশোভিত আর কেউ ছিল না। আর আজ শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসতে গিয়ে সে তার জীবনের সকল আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যকে কুরবানী করে দিয়েছে।’
এই মুসআব রা. ছিলেন মদীনার আনসারদের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রথম শিক্ষক এবং বদরযুদ্ধে মুহাজিরদের পক্ষ থেকে পতাকাবাহী। ওহুদ যুদ্ধে তিনি যখন শাহাদাত বরণ করেন তাঁর কাফনের জন্য প্রয়োজনীয় কাপড়ও ছিল না। কাপড়ের অভাবে ঘাস দিয়ে তাঁর শরীরের নিম্নাংশ ঢেকে দেওয়া হল। কোনো কোনো বর্ণনামতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন, ঈমানদার মধ্যে কেউ কেউ আছে, যারা আল্লাহর কাছে তাদের কৃত অঙ্গীকার পরিপূর্ণরূপে পালন করেছে।’-সূরা আল আহযাব ২৩
এই ওয়াদা পালনকারীদের আরেকজন ছিলেন আনসারদের নেতা সাইয়্যিদুনা সা’দ ইবনে মুয়াজ রা.। আনসার যারা ছিলেন তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মক্কা থেকে আগত মুহাজিরদের জন্য আতিথেয়তা ও নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু অচিরেই অন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হল তাঁদের। তাঁরা কি বিপুল রণসম্ভারে সজ্জিত মক্কার বিরাট সৈন্যদলের মোকাবিলা করতে প্রস্ত্তত? বদরযুদ্ধের প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত সভায় সা’দ বিন মুয়াজ রা.-এর বলিষ্ঠ ঘোষণা এ রকম- ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমরা আপনার ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করেছি, আপনার নবুওয়তের সত্যতা ও আপনার আনুগত্যের শপথ নিয়েছি। যে আল্লাহ তাআলা আপনাকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন, সেই আল্লাহর শপথ, আপনি যদি সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন, আমরা তা-ই করব। আমাদের মধ্যে এমন একজনও নেই, যে পেছনে থাকবে। … হতে পারে আল্লাহ তাআলা আমাদের মধ্য দিয়ে আপনাকে এমন কিছু দেখাবেন, যা আপনার চোখে আনন্দ ও শীতলতা বয়ে আনবে।’
এমনি অপর একজন সাহাবী হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ রা.। তিনি একদিন তাঁর ভৃত্যকে একটি ঘোড়া কিনে আনার জন্য পাঠালেন। ভৃত্যটি তিন শত দিরহামে একটি ঘোড়া ক্রয় করতঃ অশ্ববিক্রেতাকে মূল্য পরিশোধের জন্য গৃহে নিয়ে আসল। সাইয়্যিদুনা জারীর ইবনে আবদুল্লাহ রা. ঘোড়াটিকে দেখার পর বুঝলেন বিক্রেতা ঘোড়াটির মূল্য কম চেয়েছে। তিনি জানতে চাইলেন, ‘তুমি কি ঘোড়াটিকে চার শ দিরহামে বিক্রয় করবে?’ বিক্রেতা সম্মত হল। জারীর রা. বললেন, ‘পাঁচ শ হলে কেমন হয়?’ মূল্যবৃদ্ধির এই অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া তিনি অব্যাহত রাখলেন এবং শেষ পর্যন্ত আট শত দিরহাম মূল্যে হযরত জারীর রা. ঘোড়াটি কিনে নিলেন। পরে তাঁর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বললেন, ‘ঘোড়াটির প্রকৃত মূল্য সম্পর্কে বিক্রেতার সঠিক ধারণা নেই। আমি তাকে সঠিক মূল্য দিয়েছি মাত্র। কারণ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে অঙ্গীকার করেছি, আমি সর্বদা সকল মুসলমান ভাইয়ের কাছে অকপট ও শুভাকাঙ্খী থাকব।’
আরেকজন সাহাবীর কথা। যিনি একটি সোনার আংটি পরিধান করতেন। উল্লেখ্য, কোনো মুসলিম পুরুষের সোনা পরিধান করা নিষিদ্ধ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীর নিকট থেকে আংটিটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন এবং বললেন, এটা জাহান্নামের জ্বলন্ত অঙ্গার পরে থাকার সমতুল্য। পরে কেউ কেউ তাঁকে আংটিটা তুলে নিয়ে অন্য কোনো হালাল উপায়ে ব্যবহারের পরামর্শ দিলেন। কিন্তু তিনি তাদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে বললেন, ‘অসম্ভব, আল্লাহর শপথ! যে বস্ত্ত আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন আমি আর তা কিছুতেই গ্রহণ করব না।’
বলাবাহুল্য, মহান সাহাবীদের জীবন ও মনের যে স্বরূপ, এসব তার এক একটি ছোট ছোট জোনাকী সদৃশ উদাহরণ মাত্র। আসলে তাঁদের পুরো জীবনই এই ধরনের দৃষ্টান্ত দ্বারা পরিপূর্ণ। তাঁরা তাঁদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়তকে মেনে নিয়েছিলেন এবং তাঁরা পরিষ্কার জানতেন এই মেনে নেওয়ার অর্থ কী এবং সবকিছু জেনেই তাঁদের পুরো জীবন ঈমানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হল। পৃথিবীর যে কোনো বস্ত্ত ও ব্যক্তির তুলনায় তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অধিক ভালবাসতেন। তাঁরা সর্বোচ্চ নিষ্ঠা ও একাগ্রতা নিয়ে তাঁর কার্যাবলি লক্ষ করতেন এবং সর্বান্তকরণে শ্রবণ করতেন তাঁর কথা। তাঁরা সর্বক্ষণই তাঁকে স্মরণ রাখতেন। তাঁর প্রতিটি নির্দেশ তাঁরা নিঃশর্তভাবে মান্য করতেন! তাঁরা কখনও এই কথা বলেননি যে, ‘এটা তো সুন্নাহ’ (ফরয নয়)। অর্থাৎ উপেক্ষা করা যেতে পারে। তাঁরা কখনও এমন প্রশ্ন করেননি যে, এই নির্দেশ কেন দেওয়া হল। তাঁরা কখনও অজুহাত খুঁজতেন না। ঘরে-বাইরে, ব্যবসাস্থল কি জিহাদের ময়দান, ছোটোখাটো ব্যক্তিগত সমাবেশ অথবা রাজদরবার, সর্বত্রই তাঁরা ছিলেন আল্লাহ তাআলার অনুগত বান্দা, ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সর্বাধিক বাধ্য ও অকুণ্ঠ অনুসারী।
এই সাহাবীরা কেউই কখনও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মদিবস পালন বা উদযাপন করেননি। তাঁরা কেউ প্রয়োজনই অনুভব করেননি যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য কোনো বিশেষ দিবস বা মাস উৎসর্গ করা উচিত, কারণ তাঁদের পুরো জীবনই ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি উৎসর্গকৃত। কিন্তু আমাদের জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাহাবীদের অতি সামান্যই সাদৃশ্য আছে। আমরা তাঁর প্রশংসা করি, কিন্তু তাঁর কথার আনুগত্য করি না।
আমরা মুহাববতের দাবি করি, কিন্তু তাঁকে অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকি। আমরা বিশ্বাসের দাবি করি, কিন্তু আমাদের জীবন পরিচালিত অবিশ্বাসীদের মতো। আমরা সেই সকল বিষয়ে অধিক গুরুত্বারোপ করি, যে সকল বিষয় ছিল সাহাবীদের নিকট গৌণ। আর সেসকল বিষয়কে উপেক্ষা করি, যা ছিল সাহাবীদের নিকট অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুহাববত করতেন এবং তাঁদের জীবন ছিল এই মুহাববতেরই মূর্ত প্রতীক। কিন্তু আমরা? আমরা কি সৎ ও বিশ্বস্তভাবে এই কথা বলতে পারি যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যেভাবে ভালবাসা উচিত, আমরাও তাঁকে সেভাবেই ভালবাসি?