ইসলামে ব্যবসাও অনেক বড় নেক আমল হযরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ তকী উছমানী।

[হযরত তাঁর ভারত সফরকালে বিগত ৩০ শে রজব ১৪৩১হি. মোতাবেক ১৩ই জুলাই ২০১০ঈ. তারিখে আম্বুর শহরে আয়োজিত এক সম্মেলনে উপস্থিত শত শত ব্যবসায়ীদের সামনে এ ভাষণটি প্রদান করেছিলেন।  পাঠকদের জন্য ‘খুতুবাতে দাওরায়ে হিন্দ’ গ্রন্থ থেকে তার অনুবাদ দেয়া হল ।]

হামদ ও সালাতের পর…

اعوذ بالله من الشيطان الرجيم بسم الله الرحمن الرحيم

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُلْهِكُمْ اَمْوَالُكُمْ وَ لَاۤ اَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَ مَنْ یَّفْعَلْ ذٰلِكَ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْخٰسِرُوْن

সম্মানিত উপস্থিতি!

আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু।

আমার জন্য এটি অত্যন্ত আনন্দের মুহূর্ত যে, আমি আপনাদের সামনে আলোচনা করার সুযোগ পাচ্ছি। আমার এ আনন্দ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে যখন জেনেছি যে, এখানে যারা উপস্থিত আছেন তারা নিজেদের ব্যবসাকে শরীয়তের আদলে গড়ে তোলার চিন্তা ও সংকল্প নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।

আজকাল সভা-সম্মেলন তো অনেক হয়। বক্তৃতা-বিবৃতিও হয় প্রচুর। কিন্তু সেই সভা, সম্মেলন, বক্তৃতা ও বয়ান আমাদের বাস্তব জীবনে কোনো বড় পরিবর্তন সাধন করে না। এর এক কারণ, সেগুলো ‘বসলাম, বললাম এবং চলে গেলাম’ এই গতানুগতিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যায়।

কিন্তু শ্রদ্ধেয় জনাব রফিক আহমদ সাহেব এইমাত্র যে কথাটি বললেন তাতে আমি অনুপ্রাণিত বোধ করছি। তিনি বলেছেন, ‘আজ আমরা এ সংকল্প নিয়ে এই মাহফিলে সমবেত হয়েছি যে, আমরা আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আমাদের জীবনযাত্রাকে শরীয়তের আদলে ঢেলে সাজানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করব। যেসব নির্দেশনা এখানে আমরা লাভ করব তা শোনার পর এখান থেকে আমরা এ অঙ্গীকার নিয়ে উঠব যে, এখন থেকে আমরা সম্পূর্ণ নতুন মানুষ।’

কত বড় কথাই না তিনি বললেন! আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন!

মুসলমানের গোটা জীবনই হতে পারে পুণ্যময়

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর ফযল ও করমে আমাদেরকে এমন দ্বীন দান করেছেন, যার মধ্যে মানবীয় প্রয়োজনের কোনো দিককেই অবহেলা বা উপেক্ষা করা হয়নি। আপনারা জেনে থাকবেন, কুরআনে কারীম পৃথিবীতে মানব সৃষ্টির যে উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছে তা হল-

وَ مَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَ الْاِنْسَ اِلَّا لِیَعْبُدُوْنِ

আল্লাহ তাআলা বলছেন, আমি মানুষ এবং জিনকে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি। তারা আমার ইবাদত করবে- কেবল এ উদ্দেশ্যেই তাদের সৃষ্টি করেছি। [সূরা যারিয়াত (৫১) : ৫৬]

তো মানুষকে সৃষ্টি করার মূল উদ্দেশ্যই যখন এই, তখন কর্তব্য ছিল, সকাল-সন্ধ্যা, দিবারাত্রি মানুষের আর কোনো কাজ থাকবে না; শুধু আল্লাহর ইবাদত করবে।

কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর অসীম অনুগ্রহে মানুষ সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্য ইবাদত হওয়া সত্ত্বেও তাকে তার মানবীয় প্রয়োজন পূরণ করারও অনুমতি দিয়েছেন। অর্থাৎ সে নিজের ও পরিবার-পরিজনের জীবনোপকরণ এবং বসবাসের চাহিদা পূরণ করতে পারবে।

এ কারণে আল্লাহ তাআলা এমন এক দ্বীন আমাদেরকে দান করেছেন, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনের সকল চাহিদা পূরণ করতে পারি। শুধু প্রয়োজন পূরণ পর্যন্তই শেষ নয়, বরং এগুলোকে নেক আমলেও পরিণত করতে পারি।

আল্লাহর নৈকট্য

পৃথিবীতে অনেক ধর্ম এমন আছে, যার দৃষ্টিভঙ্গি হল, আল্লাহ তাআলাকে ততক্ষণ পর্যন্ত পাবেন না অর্থাৎ তাঁর নৈকট্য-সন্তুষ্টি লাভ করবেন না, যতক্ষণ না আপনি দুনিয়ার সকল কর্মব্যস্ততা ত্যাগ করে আশ্রম-উপাসনালয়ে গিয়ে ঠাঁই নিবেন এবং নির্জন সাধনার জীবন গ্রহণ করবেন। বহু ধর্ম এমন আছে, যার বক্তব্য হল- দ্বীন এবং দুনিয়া একসঙ্গে চলতে পারে না।

আপনারা তো এমন এক দেশে (ভারতে) বসবাস করেন যেখানে অবশ্যই আপনারা দেখেছেন অথবা শুনেছেন যে, অনেক মানুষ আত্মসংযম ও আত্মপীড়নের নানাবিধ আচার-সংস্কার পালন করে এ ধারণা করছে যে, আমরা খোদার প্রিয়ভাজন হয়ে গেছি। তারা কেমন সব কষ্ট-সাধনা করে। উপবাস থেকে দিন কাটায়। উদোম-উলঙ্গ হয়ে সময় যাপন করে। নিঃশ্বাস অবরুদ্ধ করে করে আত্মদমনের তপস্যা করে।

কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এমন এক দ্বীন দান করেছেন, যার মধ্যে যদিও জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ইবাদত বলা হয়েছে; কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সব কায়-কারবার ছেড়ে দিয়ে বসে যাও। বরং এমন এক আদর্শ আমাদেরকে দিয়েছেন, যার মাধ্যমে জীবনের নানাবিধ প্রয়োজনও পূরণে বাধা থাকে না, আয়-উপার্জন, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই গতিশীল থাকে। শুধু যে গতিশীল থাকে এমন নয়; বরং ব্যবসা একটি নেক আমলের রূপ লাভ করে।

সৎ ব্যবসায়ীদের হাশর হবে নবীগণ ও সিদ্দীকীনের সাথে

ছোট্ট একটি বিষয়, যার প্রতি যত্নবান হলে সকল কারবার নেক আমলে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সেটা হল, আল্লাহ তাআলা কিছু বিষয় হালাল করেছেন আর কিছুকে হারাম। তন্মধ্যে হারামকে ছেড়ে হালালকে গ্রহণ করা। পাশাপাশি একথাও বলে দিয়েছেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُلْهِكُمْ اَمْوَالُكُمْ وَ لَاۤ اَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ

তোমাদের সম্পদ এবং তোমাদের সন্তান যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করে না দেয়। -সূরা মুনাফিকুন (৬৩) : ৯

এটা হতে পারবে না যে, ব্যবসায় মত্ত হয়ে আপন দ্বীনী কর্তব্য ভুলে যাবে। আল্লাহ তাআলাকে মনে রাখবে না। বরং তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে, আল্লাহকে স্মরণ রাখা এবং হালাল পদ্ধতিতে আয় উপার্জনের চেষ্টা করা। হাদীস শরীফে এসেছে-

التّاجِرُ الصّدُوقُ الأَمِينُ مَعَ النّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشّهَدَاءِ

সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবীগণ, সিদ্দীকীন এবং শহীদগণের সঙ্গে থাকবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১২০৯

ইমাম বুখারী রাহ.-এর ব্যবসা

ইমাম বুখারী রাহ., যার কিতাব বুখারী শরীফ অত্যন্ত বিখ্যাত এবং أصح الكتب بعد كتاب الله পরিচয়ে অভিহিত, তিনিও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে ব্যবসার অঙ্গনে-

التّاجِرُ الصَدُوقُ الأَمِينُ

‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী’-এর এক আদর্শ নমুনা বানিয়েছিলেন।

ইতিহাসে তাঁর সম্পর্কে আছে যে, একবার কিছু লোক তাঁর কাছে এসে কোনো একটি পণ্যের সওদা করে চলে যায়। হযরত ইমাম বুখারী রাহ. মনে মনে ঠিক করলেন, এ পণ্যটির বিক্রয়মূল্য পাঁচ হাজার দেরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) ধার্য করব। তিনি এখনো এ বিষয়ে কোনো চুক্তি বা লেনদেন করেননি। শুধুই অন্তরে নিয়ত করেছিলেন। কিন্তু ঐ লোকদের আসতে দেরি হচ্ছিল। সম্ভবত দুয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও তারা আসল না। ইতিমধ্যে নতুন একদল গ্রাহক এসে সেই পণ্যটিই দশ হাজার দেরহাম মূল্যে কিনতে চাইল। ইমাম বুখারী রাহ. বললেন, আমার কাছে আগে একদল গ্রাহক এসেছিলেন। আমি তাদেরকে এটি পাঁচ হাজার দেরহামে দিব বলে নিয়ত করেছিলাম। তাই এখন এটা আপনাকে বিক্রি করতে পারব না। তারা বলল, এখনো তো আপনার লেনদেন পূর্ণ হয়নি!

তখন ইমাম বুখারী রাহ. উত্তর দিলেন, লেনদেন বা চুক্তি হয়নি সত্য, কিন্তু আমি মনে মনে স্থির করে নিয়েছিলাম যে, পাঁচ হাজার দেরহামে তাকে এটি দিয়ে দিব। তাই দশ হাজার দেরহামে এটি তোমাকে দিতে আমার মন আগাচ্ছে না। এভাবে তিনি এ দশ হাজার দেরহামের প্রস্তাবটি বাতিল করে দিলেন। তারপর যখন সেই প্রথম দল আসল, তখন তাদের কাছে পাঁচ হাজার দেরহামেই জিনিসটি বিক্রি করলেন। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ১/৪৮০)

সহীহ বুখারীর আরো একটি ঘটনা

এ ইমাম বুখারী রাহ.-ই তাঁর কিতাব বুখারী শরীফে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, জনৈক ব্যক্তি একজন লোকের কাছে জমি বিক্রি করল। জমিটির খরিদ্দার যখন তাতে খোঁড়াখুঁড়ি করছিল তখন ঘটনাক্রমে সেখানে স্বর্ণমুদ্রায় ভর্তি একটি কলসি বেরিয়ে আসল।

কলসিটি নিয়ে লোকটি জমি বিক্রেতার কাছে এসে বলল, ভাই, তোমার জমিতে এ স্বর্ণমুদ্রাগুলো পেলাম। তাই এগুলো তোমার। কারণ, আমি তো তোমার কাছ থেকে শুধু জমি কিনেছি, স্বর্ণ কিনিনি। উত্তরে জমিবিক্রেতা বলল, এটা আমি নেব না। কেননা, আমি যখন জমি বিক্রি করেছি, তখন তার মধ্যে যা ছিল সেটাও তোমাকে বিক্রি করে দিয়েছি। এবার দু’জনের মাঝে উল্টো ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। একজন বলে, নাও। অন্যজন বলে, নেব না।

এমনকি বিষয়টি একপর্যায়ে কাযীর দরবার পর্যন্ত চলে গেল। এবং পুরো ঘটনা তাকে জানানো হল। সবকিছু শুনে কাযী সাহেব ফায়সালা করলেন যে, তোমাদের দু’জনের কোনো ছেলে-মেয়ে আছে? সৌভাগ্যক্রমে দেখা গেল, একজনের একটি ছেলে আছে। আর অন্যজনের একটি মেয়ে আছে। কাযী সাহেব তখন বললেন, তোমার ছেলের কাছে তোমার মেয়েকে বিয়ে দাও। আর এ স্বর্ণগুলো তাদের মাঝে বণ্টন করো। এভাবেই এ ঝগড়ার অবসান হয়। -সহীহ বুখারী,হাদীস ৩৪৭২

ব্যবসা একটি নেক আমল

মোটকথা ব্যবসা যখন আমানতদারি, বিশ্বস্ততা এবং সততার সঙ্গে করা হবে তখন এটি নেক আমলে পরিণত হবে। দোজাহানের সর্দার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ব্যবসা করেছেন এবং ব্যাপক পরিসরে করেছেন। যাকে আজকাল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড (International trade) বলা হয়। এ অঙ্গনে তিনি আমাদের জন্য অনেক আদর্শ রেখে গেছেন। যদি ঈমানদারি, আমানত ও সততা আমাদের মাঝে এসে যায় তবে ব্যবসায়িক কর্মকা-গুলো নেক আমলে পরিণত হবে।

ভারতবর্ষে ইসলাম

আপনারা জানেন, ভারতবর্ষের মাটিতে যেখানে আলহামদু লিল্লাহ আজকে আমরা এত বিপুল সংখ্যক মুসলমান। এ ভূখণ্ডে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারকারীগণ মুজাহিদ ছিলেন না যে, জিহাদের মাধ্যমে তাঁরা এখানে ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছেন। কোনো তাবলীগী জামাআতও এখানে আসেনি ইসলামের দাওয়াত নিয়ে। এ অঞ্চলে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারকারী ছিলেন কিছুসংখ্যক সাহাবী ও তাবেঈ। যারা ব্যবসায়ী বেশে মালাবার অঞ্চলে এসেছিলেন। তাঁরা নিজেদের ব্যবসার মাধ্যমে এমন সুমহান আদর্শ স্থাপন করেছিলেন যে, এ অঞ্চলের মানুষের অন্তরে তাঁদের প্রতি সীমাহীন অনুরাগ জন্ম নেয়। ফলে ইসলামের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটে এবং ইসলামকে তারা একটি শ্রেষ্ঠ দ্বীনরূপে গ্রহণ করে নেয়। হযরত সাহাবা-তাবেঈন রা. -এর কর্ম ও আচরণের গুণে, তাদের সততা-বিশ্বস্ততা এবং ঈমানদারীর বদৌলতে ইসলাম প্রসারিত হয়েছিল।

আমাদের জন্য একটি সুযোগ

আজ আল্লাহ তাআলা তাঁর ফযল ও করমে আপনাদেরকে এ সুযোগটি দান করেছেন। কারণ, আপনারা এমন এক সমাজে ব্যবসা করেন, যেখানে প্রতিনিয়ত অমুসলিমদের সঙ্গে আপনাদের উঠাবসা-লেনদেন হয়। তারা আপনাদের ফ্যাক্টরীতে কাজ করে। আপনাদের দোকানে চাকরি করে।

আপনারা যদি তাদের সামনে নিজেদের আমলের সর্বোত্তম নমুনা পেশ করেন অর্থাৎ তাদের প্রতি আন্তরিক ও সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ করেন, তাদের সাথে সৎ ও ন্যায়সঙ্গত মোআমালা করেন এবং তাদেরকে সত্য দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দেন, তাহলে আপনার ব্যবসা কেবল ব্যবসাই থাকবে না; বরং একটি দাওয়াতে পরিণত হবে এবং এর একেকটি মুহূর্ত আল্লাহ তাআলার দরবারে সওয়াব ও প্রতিদান লাভের কারণ হবে। প্রতিনিয়ত অমুসলিমদের সঙ্গে আমাদের উঠাবসা হয়। কিন্তু আমাদের এ বিষয়টি মনে থাকে না যে, আল্লাহ তাআলা একজন মুসলমান হিসেবে আমাকে দ্বীনের একজন দাঈও বানিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন-

كُنْتُمْ خَیْرَ اُمَّةٍ اُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ

(মুসলমানেরা!) তোমরা সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত। সমগ্র মানবতার কল্যাণের জন্য যাদের আবির্ভাব। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১১০

সমগ্র মানবতাকে কল্যাণ ও সাফল্য এবং সঠিক পথে আনার মেহনত আমাদের দ্বীনী কর্তব্যের অংশ।

যারা অমুসলিমদের মধ্যে দাওয়াতের মেহনত করেন, তারা নিজেদের কর্ম ও আচরণের মাধ্যমে অমুসলিমদেরকে কাছে টানুন। তাদের সহমর্মী হোন। তাদের দুঃখ-দুর্দশায় শরীক হোন। এভাবে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিন। এ কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করলে আপনারা দেখবেন, সেই পরিবেশ, যা মালাবারে সাহাবায়ে কেরাম রা. সৃষ্টি করেছিলেন। ইনশাআল্লাহ সেটা আজও সৃষ্টি হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।

হালাল উপার্জনে বরকত

আসল বিষয় দুটি। এক. ব্যবসা সম্পর্কিত যে কাজই করা হোক তা যেন শরীয়তের গণ্ডির মধ্যে হয়। কোনো কোনো সময় মানুষ মনে করে, যদি আমি এ লেনদেনে শরীয়তের হুকুম অনুযায়ী আমল করতে যাই, তাহলে আমার টাকা কমে যাবে অথবা মুনাফায় ঘাটতি দেখা দিবে। কিন্তু এটা অনেক বড় ধোঁকা।

মনে রাখবেন, আসল জিনিস টাকার পরিমাণ বা কোয়ান্টিটি (quantity) নয়; আসল হচ্ছে তার মান ও কোয়ালিটি (quality)। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাআলা এরই মধ্যে বরকত দান করে থাকেন। আপনারা দেখে থাকবেন, কখনো কখনো সামান্য টাকার মধ্যে আল্লাহ তাআলা এত বরকত দান করেন যে, এর দ্বারা অগণিত কাজ সম্পাদিত হয়ে যায়। আর কোনো সময় অঢেল টাকার স্তুপ থাকে; কিন্তু তার সবটাই রোগ-শোক, হাসপাতাল আর আইন-আদালতের পিছে ব্যয় হয়ে যায়।

তাহলে বলুন, যেই বিপুল পরিমাণ সম্পদ হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে খরচ হল এবং উকিলদের চেম্বারে আইন-আদালত করতে গিয়ে ব্যয় হয়ে গেল, সেটা উত্তম, না সেই অল্প সম্পদ, যা দ্বারা আপনি ভরপুর লাভবান হলেন? আল্লাহ তাআলা সর্বদা বরকত রেখেছেন হালাল উপার্জনে ।

হারামের মধ্যে বে বরকতি

হারাম সম্পদে বরকত হয় না। আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

یَمْحَقُ اللهُ الرِّبٰوا وَ یُرْبِی الصَّدَقٰتِ

আল্লাহ সূদকে ধ্বংস করেন আর সদকাকে বাড়িয়ে দেন। -সূরা বাকারা (২) : ২৭৬

মানুষ বলে, সূদে তো সম্পদ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কুরআন বলছে, বৃদ্ধি পায় না; বরং তার বরকত খতম হয়ে যায় এবং তার শান্তিও শেষ হয়ে যায়।

গণনার পৃথিবী

আজকের পৃথিবী নিছক গণনার পৃথিবী হতে চলেছে। গণনার কারণে মানুষ ভাবছে, আমাদের অর্থের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে আমরা লাভবান হয়ে যাব। প্রকৃতপক্ষে গণনার প্রবৃদ্ধি লাভের পরিবর্তে লোকসানই ডেকে আনছে।

তাই আমরা পূর্ণ প্রতিজ্ঞা করে নেই, যেটুকু অর্থ আসবে তা যেন হালালভাবে আসে; যেভাবে শরীয়ত হালাল করেছে। তা পরিমাণে কম হলেও ইনশাআল্লাহ তার মধ্যে আল্লাহ তাআলা এমন বরকত দান করবেন, যা অঢেল সম্পদের মধ্যেও হয় না। ব্যস, আমরা এ সংকল্প করে ব্যবসায় নেমে পড়ি। আল্লাহর রহমতে আশা করা যায়, এ ব্যবসা নেক আমলে পরিণত হবে এবং দুনিয়া ও আখেরাতে তার ফায়দা অনুভব করা যাবে।

ব্যবসা তরবিয়তের ওসিলা

আল্লাহ তাআলা ব্যবসাকে এমন এক মাধ্যম বানিয়েছেন যে, এটা মানুষের তরবিয়ত করে। এমনি তো পৃথিবীতে পেশার সংখ্যা অনেক। কিন্তু ব্যবসার মধ্যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের প্রশিক্ষণ হয়। যে লোক কোথাও কোনো চাকরি করছে, তার তো জানা আছে যে, মাস শেষে আমি এ পরিমাণ বেতন পাব।

কিন্তু ব্যবসায়ী যখন ব্যবসা করে তখন সে নিশ্চিতরূপে কিছুই জানে না যে, কী অর্জন হবে! এজন্য তার পুরো ব্যবসা এবং সকল কাজ আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। আর এ তাওয়াক্কুলই এমন মহৎ গুণ, যা মানুষের অন্তর্জগৎকে অসাধারণ তরবিয়ত করে।

আমার বড় ভাইয়ের ঘটনা

আমার সর্বজ্যেষ্ঠ ভাই মাওলানা যাকী কায়ফী ছাহেব, যিনি একজন স্বনামধন্য কবিও ছিলেন। ‘কায়ফিয়্যাত’ নামে তাঁর কাব্য সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে। যদিও তিনি দরসে নেযামীর পাঠ পূর্ণ করেননি, কিন্তু উলামায়ে কেরাম এবং বুযুর্গদের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। তিনি কিতাবাদীর ব্যবসা করতেন।

তিনি একবার তাঁর নিজের ঘটনা শুনাচ্ছিলেন যে, একদিন সকালে আমি উঠে দেখি বাইরে প্রচ- বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তাঘাটে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় হাঁটু সমান পানি ছিল। আমার অন্তরে খেয়াল এল, আজ এই বৃষ্টির মধ্যে কে আমার কাছে কিতাব নিতে আসবে। সাধারণত এরূপ সময়ে লোকজন সর্বোচ্চ তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বের হয়। কিতাব কেনার জন্য কে আসবে; তাও আবার দ্বীনী কিতাব! তাই আজকে আমি দোকান খুলব না।

এ ভাবনা আমার অন্তরে আনাগোনা করছিল। কিন্তু যেহেতু (ভাইজান) বুযুর্গদের সোহবতপ্রাপ্ত ছিলেন, তাই তৎক্ষণাৎ মন থেকেই উত্তর এসে গেল যে, গ্রাহক আসুক বা না আসুক। সেটা তোমার কাজ নয়। ব্যস, দোকান খুলে বসে যাও। গ্রাহক পাঠাবেন তো ‘আরেকজন’। তিনি যদি চান তাহলে এ বৃষ্টির মধ্যেও গ্রাহক পাঠিয়ে দিবেন। অতএব, তুমি তোমার কাজ কর। আল্লাহ তাঁর কাজ করবেন।

ভাইজান বলেন, আমি ছাতি নিয়ে পানির মধ্যে বের হলাম। এরপর দোকান খুলে বসে তিলাওয়াত আরম্ভ করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে লক্ষ করলাম, লোকজন ছাতি মাথায় দোকানে কিতাব কেনার জন্য আসতে শুরু করেছে।

ব্যবসা অন্যান্য পেশা অপেক্ষা শ্রেষ্

তো আমি আরয করছিলাম যে, গ্রাহক পাঠানো মূলত আল্লাহ তাআলার কাজ। আমরা ব্যবসার মাঝে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের একটি শিক্ষা খুঁজে পাই। এজন্যই আল্লাহ তাআলা ব্যবসার পেশাকে অন্যান্য পেশার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। শুধু শর্ত একটি- শরীয়ত এবং সুন্নত মোতাবেক হতে হবে এবং তাতে মগ্ন হয়ে আল্লাহ থেকে গাফেল হওয়া যাবে না।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন।

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.