ইসলামী চেতনার অতন্দ্র প্রহরী আবু বকর সিদ্দীক বড় উস্তাদজী (রহ.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
ইতিহাসের নিভৃতচারী এক বিরল ব্যাক্তিত্বের নাম আবু বকর সিদ্দিক (রহ.) যিনি ছিলেন সমাজ সেবক ও সংস্কার, বিশিষ্ট দাঈ, দ্বীন দরদী। জ্ঞানের অনুরাগী, বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। অগনিত মানুষের উস্তাদ, আল্লাহভীরু ও বাতিলের সাথে আপোসহীন এক অনুপম ব্যক্তিত্ব।
আবু বকর সিদ্দিক বড় উস্তাদজী
তিনি ৭/৫/ ১৯৩২ ইং তারিখে ঐতিহাসিক মাইজদি শহরের অধীনস্ত নেওয়াজপূর ইউনিয়নের ধর্মপূর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন।
তার পিতা জনাব আব্দুল জব্বার বিন মুন্সি আমীনুদ্দীন (রহ.) যিনি একজন সরলমনা ও ধর্মানুরাগী এবং আল্লাহভীরু মানুষ ছিলেন। তিনি হাজীও ছিলেন।
তার মাতার নাম: যুলাইখা বেগম। তিনি একজন সম্ভ্রান্ত ও আল্লাহভীরু রমনী ছিলেন।
তিনি শিশু কালেই মা‘কে হারান। তাই শৈশব ও কৈশর কাল অতিক্রম করেন তার বাবা নানীর নিয়ন্ত্রণে। এবং শিশুকাল থেকেই তিনি সভ্য ভদ্র ও নম্র প্রকৃতির ছিলেন।
তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন নিজ এলাকার মকতব ও প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। অতঃপর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করেন ঐতিহাসিক মাইজদি কারামাতিয়া আলীয়া মাদরাসা থেকে।
পূর্বসূরীদের নিয়ম অনুযায়ী এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় সফর করার রীতি চালু আছে। সেই ধারাবাহিকতায় তাঁর বাপ-দাদারা নোয়াখালী থেকে মাগুরায় হিজরত করেন। এবং শাজিরকান্দী গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তাদের সাথে তিনিও আগমন করেন।
তাঁর সততা, আমানতদারীতা, আল্লাহভীরুতা, কর্মঠতা ও অনন্য গুনাবলী দেখে এলাকার সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তি জনাব ইসকেন্দার ইবনে হাজি শরাফাতুল্লাহ নিজের একমাত্র আদরের কন্যাকে ১৯৪৮ অথবা ১৯৫০ সনে তার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করান।
তিনি যখন পরিবারের লোকদের সাথে মাগুরায় আসেন তখন তিনি এক তাগড়া যুবক। পরিশ্রমী ও ধর্মভীরু মানসিকতার অধীকারী হওয়ার কারণে মাগুরা এসেই নিজেকে দ্বীন সমাজ সেবায় সপে দেন। এবং সমাজ সংস্করণে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেন ও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন।
তিনি শিক্ষানুরাগী এবং বজুর্গদের সোহবতপ্রাপ্ত একজন সৌভাগ্যবান মানুষ ছিলেন। নবী করীম (স.) এর সচ্ছা আশেক এবং অনুসারী হওয়ায় তার দিলেও উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার দরদ ছিল ভবপূর। ফলে দ্বীনের মিশন বাস্তবায়নে একেবারে শুরু লগ্নেই একটি মসজিদ এবং একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে দ্বীনের ও জ্ঞানের আলো ছড়াতে থাকেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি বহু মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। এভাবেই তার মেহনত পরিব্যাপ্ত হতে থাকে। অতঃপর নিজ এলাকার ছেলে মেয়ে ও আপন সন্তান সন্ততীদের শিক্ষা দীক্ষার লক্ষ্যে বাড়ীর অদুরেই একটি দ্বীনি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া আশপাশের সকল মাদরাসার সাথে তাঁর সংশ্লিষ্টতা ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক ও এলাকা ভিত্তিক ধর্মীয় এবং জাগতিক শিক্ষার নিজেকে ব্যাস্ত রাখায় একপর্যায়ে তিনি বড় উস্তাদজী উপাধিতে ভুষিত হন।
তিনি ছিলেন কর্মঠ ও উদ্যেমী। কখনো অযথা সময় নষ্ট করতেন না। নিজ বাড়ী ও সমাজে সমান ভাবে মেহনত করতেন।
সমাজের লোকদের মাঝে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন তাঁর হৃদয় ব্যকুল থাকতো, তেমনি আপন সন্তানদের শিক্ষা দীক্ষা ও দ্বীন শেখানোর ব্যাপারে তার মন থাকতো বিচলিত। দুনিয়াবী লোভ লালসা করতেন না। তাই আপন সন্তানরা প্রখর মেধার অধিকারী হওয়া সত্বেও তাদেরকে দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিত না করে বরং দ্বীনি শিক্ষা দান করেন। আজ তার বংশে শতশত হাফেজ আলেম, মুফতি ও মুহাদ্দিস রয়েছে। এবং অসংখ্য ছাত্র আছে যারা ইলমে দ্বীন শিক্ষা মগ্ন রয়েছে। আমরা মনে করি এটা তার উস্তাদ, শাইখ এবং বুজুর্গদের নেক নজর ও তার একনিষ্ঠতা এবং এখলাসের ফসল। ইলমের প্রতি তাঁর অসীম অনুরাগ থাকায় তিনি তালেবে ইলমদের অত্যাধিক ভালবাসতেন। কোন তালেবে ইলমকে পেলে মেহমানদারী ও ইকরাম করা ছাড়া তাকে বিদায় দিতেন না।
তার এই কর্মময় অনন্য জীবনের সাক্ষী সমকালীন বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ ও উলামায়ে কেরাম। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে এত বিশদ আলোচনা যা দুরহ ব্যাপার….
তিনি তাঁর পাশের গ্রামে যেই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেখানেই আজীবন ইমাম ও খতীব এর দায়িত্ব পালন করেন। মসজিদকে তিনি দ্বীনের এক মারকাজে রুপান্তরিত করেছিলেন। মানুষকে মসজিদমুখী ও দ্বীনমুখী করার মেহনতে সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন। শিশু কিশোর, যুবক, মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধ কাউকে তিনি ছাড়তেন না। সকলেই কিভাবে দ্বীনের আলোয় আলোকিত হতে পারে এই চিন্তাই তাকে তাড়া করে ফিরত সদা। নিজে তো মেহনত করতেনই, সাথে উলামায়ে কেরামকে পেলে তাদের থেকে উপকৃত হতেন এবং তাদের সাহায্য নিতেন। তাঁর মেজো ছেলে যিনি করাচীর হযরত আল্লামা শাহ হাকীম আখতার (রহ.) এর অন্যতম খলীফা মুফতী নূরুল আমীন সাহেবের দ্বারা উক্ত মসজিদে অনেক ইসলাহী প্রগ্রাম করিয়েছেন। এভাবেই তিনি অন্ধকারচ্ছ সমাজে আলো প্রজ্জ্বলিত করার মেহনতে জীবনকে ব্যয় করেছেন।
ইলমের খেদমত করার জন্য তো দ্বীনি প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন। তথাপী একটা বিরাট সংখ্যার মানুষ ইলম তথা কুআনের নূর থেকে বঞ্চিত ছিল। তারা এ ব্যাপারে উদাসীন ছিল। দুনিয়া নিয়েই ব্যস্ত ছিল। যেমনটি এখনও লক্ষ করা যায়। তিনি সকাল দুপুর সন্ধা ও রাতে সেসকল বে তলব ও বে গরজ মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে তাদেরকে কুরআনের তালীম দিতেন। প্রয়োজনের আলেম ও তালেবে ইলমদের সাহায্য নিতেন।
তিনি ইসলাহে নফস তথা আধ্যাত্মিক জগতের গভীরে বসবাস করতেন। আমরণ আত্মশুদ্ধির মেহনতে জীবন পরিচালনা করেন। সর্বপ্রথম বাংলাদেশের উম্মুল মাদারিস হাটহাজারী মাদরাসার তৎকালীন প্রধান মুফতি ও বাংলাদেশের মুফতীয়ে আজম হযরত মাওলানা মুফতি আহমাদুল হক সাহেব (রহ.) এর নিকট পত্রযোগে বাইআত গ্রহন এবং ইসলাহী তাআল্লুক করেন। অতঃপর রুমিয়ে যামান মুজাদ্দিদে মিল্লাত তবীবুল উম্মাহ হযরতুল আল্লাম হযরত মাওলানা শাহ হাকীম মুহাম্মাদ আখতার সাহেব করাচী (রহ.) এর হাতে তার বাংলাদেশের প্রধান খানকা ও মারকায ঢালকানগর মাদরাসায় গিয়ে সরাসরি বাইআত গ্রহন করেন এবং তার ৪র্থ ছেলে মুফতি মুমতাজুল করীমের সাথে সেখানে এক চিল্লা দেন।(এই ৪র্থ ছেলেও পরবর্তীতে করাচী হযরতের খেলাফত লাভ করেন)। অতঃপর এলাকায় থেকে হযরতের খলীফাগণের সাথে সম্পর্ক রেখে জীবন পরিচালনা করেন। তার দ্বীনি লাইনের এই উচ্চ শিখরে পৌঁছার পিছনে যেই কারন ও আমাদের জন্য যেই শিক্ষা রয়েছে তা হচ্ছে বুজুর্গ ও আহলুল্লাহদের সোহবতের বরকত। মানুষ উঁচ্চ মর্যাদায় পৌঁছার জন্য অবশ্যই বুজুর্গদের সহচর্য লাভ করতে হবে। নিজস্ব কখনই কামিয়াব হওয়া যাবেনা। এই শিক্ষাই তিনি আমাদের দিয়ে গেলেন।
তিনি কর্ম জীবনে অন্যান্য খেদমতের পাশাপাশি পুরোদমে দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনত করেতেন। এলাকার ছোট বড় সকলেরে দারে দারে এই মেহনতের ফিকিরে ফিরতেন। মানুষকে তাশকীল করে চিল্লায় পাঠাতেন এবং অনেককে নিজ খরচও প্রদান করতেন।
নিজেও চিল্লা দিয়েছেন। অবশেষে চাকরী হতে অবসর গ্রহনের পরেও এক চিল্লা দেন।
তিনি উত্তম গুণাবলী ও সুরুচির অধিকারী ছিলেন। মুখে থাকতো যিকির অন্তরে থাকতো ফিকির। তার মুখ হতে সর্বদাই যিকরের গুণগুণ ধ্বণি বেরিয়ে আসতো। তাকওয়া, সততা, মেহতন সহ যাবতীয় গুণাবলী তার মাঝে বিদ্যমান ছিল। নিভৃতে আল্লাহর ইবাদতে তিনি আত্ম প্রশান্তি লাভ করতেন। মধ্যরাতে ইবাত বন্দেগী তাঁর স্বভাবে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। অধিক পরিমানে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। উম্মতের জন্য তার হৃদয় সাদা ব্যকুল থাকতো। আল্লাহর রাস্তায় খরচের ব্যাপারে তার হাত ছিল লম্বা আর হৃদয় ছিল প্রশস্ত। মুসলমানের একরাম, সৃষ্টির সেবা, ছোটদের স্নেহ, বড়দের সম্মান এবং উলা্মায়ে কেরামের তা’যীম করা ছিল তার উত্তম গুণাবলীর অন্যতম।
তিনি ১৯৮৭ সনে পবিত্র বাইতুল্লাহর মেহমান হয়ে হজব্রত পালন করেন এবং মদীনা মুনাওয়ারা জিয়ারত করে ধন্য হন।
দীর্ঘ ৪১ বছর নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত প্রাইমারী স্কুলে নিষ্ঠার সাথে শিক্ষকতা করার পরে ১৯৯৫ সালে তিনি চাকরী থেকে অবসর গ্রহন করেন।
তার ৯ ছেলে ও ৫ মেয়ে। (৪ মেয়ে জীবিত) বর্তমানের তার বংশের সদস্য সংখ্যা প্রায় ২৫০। যাদের মধ্যে হাফেজ রয়েছে ৬৭ এবং মুফতি রয়েছে ২৬ দাওরা ফারেগ ৬৫ জন। এবং তালেবে ইলমের সংখ্যা অনেক। আলহামদুলিল্লাহ তার ইখলাসের বদৌলতে তার বংশের লোকেরা সবাই দ্বীনের উপর রয়েছে।
৪/৭/২০০৮ ইং তারিখে ইহধাম ছেড়ে তিনি আল্লাহর সাথে মিলিত হন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিঊন।